ঢাকা,শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪

কাল রবিবার বিশ্ব ভালবাসা দিবসে চকরিয়ায় চাষিদের কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট

Chotan-Chakaria-Pic.-11.02.16-300x205ছোটন কান্তি নাথ :
আগামী রবিবার বিশ্ব ভালবাসা দিবস। এই দিবসে প্রতিটি মানুষ তার প্রিয়জনকে আলাদা করেই ভালবাসতে পছন্দ করেন। বিশেষ করে এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে যুবক-যুবতীদের আয়োজনের কমতি থাকেনা। আর ফুল ছাড়া তো এই ভালবাসা দিবস উদযাপনে কথা চিন্তাও করা যায়না। তাই চাহিদা মেটাতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার ব্যবসায়ীরা কক্সবাজারের চকরিয়ার গোলাপ নগর খ্যাত বরইতলী ও হারবাং থেকে আগেভাগেই বিভিন্ন প্রজাতির ফুল কিনে নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে পাইকাররা আগাম অর্ডারও দিয়ে রেখেছেন। তাছাড়া গত বছরের মতো দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকায় এবারের ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে কোটি টাকার ফুল বিক্রি হবে এমন আশাই করছেন চাষিরা।
বরইতলী ও হারবাং ইউনিয়নের ফুল চাষিরা জানান, গত দুইবছর দেশব্যাপী ২০ দলীয় জোটের ডাকা টানা অবরোধ-হরতালের প্রভাব পড়ে গোলাপ নগর খ্যাত বরইতলী ও হারবাং ইউনিয়নে। এই দুইবছর দেড় শতাধিক বাগানের গ্লাডিওলাস ও গোলাপ ফুল বিক্রি করতে না পেরে ক্ষেতেই নষ্ট হয়ে গেছে। ওইসময় বিক্রি তেমন না থাকায় বাগান থেকে ফুল তোলা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেকটা বেকার সময় পার করেছেন তিন শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিক। এতে এসব পরিবারেও আর্থিক-অনটন দেখা দেওয়ায় দুর্বিষহ জীবন-যাপন করতে হয় শ্রমিকদের। এই সময়ের মধ্যে অন্তত তিন কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে হাজারো ফুল চাষির। তবে এখন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক থাকায় বেশ খুশিমনে ফুল চাষে নামেন চাষিরা। এতে চলতি বছর পুরোদমে ও কর্মচাঞ্চল্যতা ফিরে আসে ফুলের রাজ্য বরইতলী ও হারবাং ইউনিয়নে।
চকরিয়ার বরইতলী থেকে পাইকারি দরে কিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে ফুল বিক্রি করেন সুভাষ দে। তিনি  বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে ৫-১০ হাজার পিস ফুল কেনা হয় চকরিয়ার বরইতলী থেকে। আর বিশেষ দিবসে তা কয়েকগুন ছাড়িয়ে যায়। এবারের ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে আগাম অর্ডার দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার গোলাপ ও গ্লাডিওলাস ফুলের।’
বরইতলী একতা বাজার এলাকার ফুলচাষি নজির আহমদ বলেন, ‘আমি একসময় তামাকের চাষ করতাম। তখন মুনাফাও ভাল পেয়েছিলাম। কিন্তু হাড়ভাঙা খাটুনি ও দিন-রাত পরিশ্রমের কারণে শরীরের অবস্থা তেমন ভাল যাচ্ছিল না। তাই অন্যের দেখাদেখিতে তামাক চাষ ছেড়ে গত দুইবছর ধরে উদ্যোগী হই ফুল চাষে। কিন্তু গত দুইবছর রাজনৈতিক অস্থিরতা কারণে ফুল বিক্রি হয়নি। এতে কম করে হলেও চার লক্ষ টাকার ক্ষতি হয়েছে। তবে সেই অবস্থার পরিবর্তন হওয়ায় এবারও দুইকানি জমিতে গোলাপ ও গ্লাডিওলাস ফুলের চাষ করেছি। ফলনও ভাল হওয়ায় বেশ খুশি লাগছে।’
নজির আহমদ আরো বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে বাগান থেকে ফুল তোলার পর চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাইকাররা সরাসরি এসে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেকে পাইকার আগাম অর্ডারও দিয়ে রেখেছেন ভালবাসা দিবস উপলক্ষ্যে। এতে এবার কম করে হলেও দুই লক্ষ টাকার ফুল বিক্রি করতে পারব আমি।’
চাষিরা জানান, দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকা প্রতিটি গোলাপের দাম মানভেদে পাইকারিভাবে বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার টাকায়। আর রকমারী রংয়ের গ্লাডিওলাস ফুল বিক্রি হচ্ছে ১০ থেকে ১৫ টাকায়। এতে চাষির পাশাপাশি বাগান পরিচর্যা ও ফুল তোলায় নিয়োজিত তিন শতাধিক নারী-পুরুষ শ্রমিকের মুখেও হাসি ফুটেছে নিয়মিত পারিশ্রমিক পাওয়ায়।
বাগান শ্রমিক বরইতলী পূর্ব পাড়ার নূর আয়েশা, ছলেমা খাতুন বলেন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল থাকায় ফুল বাগানে শ্রম দিয়ে প্রতিদিন রোজগার করছি। এতে পরিবারের অভাব-অনটন বলতে গেলে আর নেই। যা গত দুইবছর আমাদেরকে বেশ পীড়া দিয়েছিল রাজনৈতিক অস্থিরতা।’
সরেজমিন ফুল চাষি ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের গোলাপ ফুলের গ্রাম কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বরইতলী ও হারবাং ইউনিয়নের দেড় শতাধিক বাগান থেকে প্রতিদিন চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গোলাপ ও গ্লাডিওলাস ফুল সরবরাহ করা হয় পাইকারদের কাছে। বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে এসব বাগানের ফুলের ব্যাপক কদর রয়েছে। গত দুই দশক ধরে এখানকার চাষীরা রুটি-রুজির একমাত্র অবলম্বন হিসেবে ফুল চাষ করে আসছেন। প্রথমদিকে সামান্য জমিতে নানা জাতের ফুলের চাষ হলেও বর্তমানে দুই ইউনিয়নের অন্তত ১২০ একর জমিতে চাষ হচ্ছে ফুলের।
বরইতলী ফুল বাগান মালিক সমিতির আহবায়ক মো. মইনুল ইসলাম বলেন, ‘গত দুইবছর তো টানা অবরোধ-হরতালের কবলে পড়ে ফুলচাষিরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল। তবে এবার সেই পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় পুরোদমে ফুলচাষে নেমেছে চাষিরা। তাই আশা করছি, এবারের ভালবাসা দিবসে গোলাপ, গ্লাডিওলাসসহ রকমারী ফুল বিক্রি হবে কোটি টাকার। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের পাইকারী ক্রেতারা বাগানে এসে ফুল নিতে শুরু করেছে। অনেকে আগাম অর্ডারও দিয়ে রেখেছেন চাষিদের। গতকাল বৃহস্পতিবার থেকে তিনদিন সবকটি বাগানের সিংহভাগ ফুল বিক্রি হবে।’
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আতিক উল্লাহ বলেন, ‘বরইতলী ও হারবাং ইউনিয়নের ১২০ একর জমিতে পুরোদমে ফুলের চাষ করছে হাজারো চাষি। গত দুই বছরের মতো রাজনৈতিক উত্তাপ না থাকায় এবারের ভালবাসা দিবসসহ সবকটি দিবসে ফুল বিক্রিও ভাল হবে। এতে আর্থিকভাবে বেশ লাভবান হবে চাষিরা।’
বরইতলী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান এটিএম জিয়াউদ্দিন চৌধুরী জিয়া বলেন, ‘আমার ইউনিয়নের সিংহভাগ মানুষ তাদের জমিতে তামাকের আবাদ করতো একসময়। তামাক আবাদের কারণে যেভাবে পরিবেশ এবং শারিরিক ক্ষতি হয় তা আমি তাদের বুঝাতে সক্ষম হয়েছি। তাই তারা দীর্ঘ কয়েকবছর ধরে তামাক চাষ ছেড়ে ফুলচাষের দিকেই প্রলুব্ধ হয়। ইতিমধ্যে ফুলচাষ করে আমার ইউনিয়নের অসংখ্য মানুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। কিন্তু মাঝে-মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার যাঁতাকলে পড়ে তারা নিঃস্ব হতে থাকে। তবে বর্তমানে  রাজনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা থাকায় ফুল বিক্রিও বেড়ে গেছে।’

পাঠকের মতামত: